উনিশ শ' একাত্তর সালে শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলন সারাবাংলার মানুষের মতো পুলিশ বাহিনীর সদস্যদেরও প্রভাবিত করেছিল। অসহযোগ আন্দোলনের শুরু থেকেই রাজশাহীতে কর্মরত বাঙালি পুলিশ সদস্যদের মধ্যে বিদ্রোহের আভাস পরিলক্ষিত হতে থাকে। রাজশাহী পুলিশ লাইন্সের সদস্যরা সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ লাইন্সের চতুর্দিক ঘিরে গভীর পরিখা খনন করে পুলিশ লাইন্সের অভ্যন্তরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বাংকার তৈরি করে রাখেন। পুলিশ লাইন্সের চারপাশ দিয়ে তার টানিয়ে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা করা হয় যাতে রাতে কেউ পুলিশ লাইন্সে প্রবেশ করতে না পারে। এ সময় পরিখার মধ্যেও পালাক্রমে সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা করা হয়।
অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা মোতাবেক ২৬ মার্চ রাজশাহীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দায়িত্বপ্রাপ্ত ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেসপ্যাচ সিও শওকত বালুচ তৎকালীন ডিআইজি মামুন মাহমুদকে তাঁর অধীন পুলিশ সদস্যদের আত্মসমর্পণ এবং অস্ত্রাগারের চাবি তাদের নিকট হস্তান্তর করতে বলেন। ডিআইজি মামুন মাহমুদ বিষয়টি ভেবে দেখবেন বলে জানান। ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ রংপুর ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আব্দুল্লাহর কাছ থেকে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে যাওয়ার বেতার মেসেজ আসলে সন্ধ্যা ৬ টার দিকে সৈন্যদলসহ পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন কর্তৃক ডিআইজি বাসভবন ঘেরাও করে এবং ডিআইজি মামুন মাহমুদকে বন্দি করে রংপুর সেনানিবাসে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে ডিআইজি মামুন মাহমুদ এবং তার ড্রাইভার ও দেহরক্ষীর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তৎকালীন রংপুরের জেলা প্রশাসক শামীম আহসানের দেওয়া তথ্যমতে ডিআইজি মামুন মাহমুদকে রংপুর ব্রিগেড সদর দপ্তরে ডেকে হত্যা করা হয়।
রাজশাহী পুলিশ লাইন্স বধ্যভূমি
২৬ মার্চ রাত ১২.০৫ মিনিটের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কয়েকটি গাড়ির একটি কনভয় গীর্জার পাশ দিয়ে পুলিশ লাইন্সের অভ্যন্তরে প্রবেশের চেষ্টা করে। তবে পুলিশ সদস্যদের প্রতিরোধের মুখে সেনাবাহিনী পুলিশ লাইন্সে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়। এই সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ডিআইজি অফিসের পিছনে নদীপাড়ে, লক্ষীপুর মোড় ইপিআর লাইন্সের পাশে এবং রেডিও সেন্টারের ভিতরে অবস্থান গ্রহণ করে।
২৭ মার্চ সকালে জেলা পুলিশ সুপার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে আলোচনার বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য পুলিশ লাইন্সে আসলে পুলিশ সদস্যগণ সম্মিলিতভাবে আলোচনার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান। সমস্বরে তাঁরা বলেন, "আমরা মরলে একসাথে মরবো কিন্তু পাকিস্তানিদের গোলামি করবো না"। তখন পুলিশ সুপার শাহ্ আব্দুল মজিদ উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, "তোমরা পারলে কিছু কর। আমি যতদূর সম্ভব তোমাদের সাহায্য করব"।
একই দিন বিকেল সাড়ে ৪ টায় সেনাবাহিনীর ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈনিকরা পূর্ণ যুদ্ধসাজে রাজশাহী উপ-শহর সেনানিবাস থেকে পুলিশ লাইন্সের দিকে যাত্রা শুরু করে। এ সংবাদ পেয়ে পুলিশ লাইন্সে আন্দোলনরত পুলিশ সদস্যগণ তাদের প্রতিহত করতে প্রস্তুতি গ্রহণ করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী’র কনভয় পুলিশ লাইন্সের সন্নিকটে গীর্জার কাছাকাছি পৌঁছানো মাত্রই পুলিশের রাইফেল একসাথে গর্জে উঠে। উভয় পক্ষের মধ্যে রাতভর গোলাগুলি চলে। পুলিশ সদস্যরা অত্যন্ত সুরক্ষিত অবস্থানে থাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর অগ্রসর হতে পারে না। এ যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়।
২৮ মার্চ সকাল ১০.০০ টার দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মেজর রাজশাহী জেলার এডিসিসহ সাদা পতাকা উড়িয়ে রাজশাহী পুলিশ লাইন্সে প্রবেশ করে গুলি বন্ধের জন্য মাইকে প্রচার চালাতে থাকেন। এই সময় মাইকে একজনকে বলতে শোনা যায় "আমরা পবিত্র কোরআন শপথ করে বলছি, আমরা আর গুলি করবো না"। সেনাবাহিনীর ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর অন্যান্যদের সাথে নিয়ে নিরস্ত্র অবস্থায় পুলিশ লাইন্সে পৌঁছে পূর্বের ন্যায় ধর্মের দোহাই দিয়ে বলেন, "আমরা সকলে মুসলমান। ঢাকায় বাঙালি নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা হচ্ছে, একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।" এরপর মেজর তার অন্যান্য সাথীদের নিয়ে সেনানিবাসের উদ্দেশ্যে পুলিশ লাইন্স ত্যাগ করেন। তখন পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যগণ অনেকটা বিভ্রান্ত হয়ে ব্যারাকে ফিরে আসেন।
স্মৃতিসৌধ
একই তারিখ বেলা ১.০০ টা। প্রায় সকল পুলিশ সদস্য দুপুরের আহারের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় পুলিশ লাইন্সের উপর মর্টার শেলিং ও মেশিনগানের গুলি বর্ষণ শুরু হয়। রকেট লাঞ্চারের শেলের আঘাতে প্রথমে পুলিশের বেতার টাওয়ারটি ভেঙে পড়ে। কয়েকটি ব্যারাকে আগুন লেগে যায়। পুলিশ সদস্যরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই আকস্মিক আক্রমণে হতবিহ্বল হয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন। যে সমস্ত পুলিশ সদস্যরা বাংকারের ভিতরে পজিশনে ছিলেন তাঁরা সাহসের সাথে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। অনেকে দ্রুত রাইফেল-গুলি নিয়ে বাংকারে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পুলিশ সদস্যগণ পূর্বের ন্যায় প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হন।
একপর্যায়ে প্রতিরোধ ভেঙে পড়লে পুলিশ সদস্যরা ভেড়িপাড়ার মধ্যদিয়ে পুলিশ লাইন্স ত্যাগে বাধ্য হন। এই যুদ্ধে ১৮ জন বাঙালি পুলিশ সদস্য শাহাদাত বরণ করেন। কিন্তু ১৭ জনের নাম পরিচয় জানা যায়। এই যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন এসআই সোহরাব আলী (ভারপ্রাপ্ত আরআই) এবং পিআরএফ এর আরআই রইস উদ্দিন। তারা উভয়ে শেষ মুহূর্তে পুলিশ লাইন্স ত্যাগ করেন। ২৯ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজশাহী জেলার বোয়ালিয়া থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দৌলত খানের নিকট ১৮ জন পুলিশ সদস্যের লাশ হস্তান্তর করেন। পুলিশ লাইন্সের অভ্যন্তরে বাবলা বাগানের ভিতর তাঁদের সমাহিত করা হয়। এছাড়াও পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে এক যুদ্ধে আহত এসআই মোহম্মদ আলী মন্ডলকে বন্দি করে রাজশাহী পুলিশ লাইন্সে নিয়ে এসে অত্যাচার করে হত্যা করা হয়। তাঁকেও এখানে সমাহিত করা হয়।
৩১ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কতিপয় সদস্য জেলা প্রশাসকের বাসভবন থেকে রাজশাহী জেলার পুলিশ সুপার শাহ্ আব্দুল মজিদকে বন্দি করে পদ্মা তীরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। তাঁর মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া যায়নি। মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী পুলিশের অবদান রাজশাহীবাসী কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে।